বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির জন্য সুপরিচিত। মসলিন, মসজিদ আর রিকশার শহর হিসেবে একসময় পরিচিত এই নগরী আজ এক বিশাল মহানগরে রূপ নিয়েছে, যেখানে অতীতের স্মৃতি ও আধুনিকতার সম্মিলন ঘটেছে এক অভাবনীয় ছন্দে। এই শহরের বুকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের এক জ্বলন্ত নিদর্শন হলো রমনা পার্ক—যা শুধু একটি উদ্যান নয়, বরং একটি শহরের ঐতিহ্য ও প্রকৃতির মিলনস্থল।
সূচিপত্র
মুঘল আমল থেকে আধুনিক রমনা
রমনার ইতিহাস শুরু হয় মুঘল শাসনামলে, আনুমানিক ১৬১০ সালে, যখন সুবাদার ইসলাম খান সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তখন রমনা ছিল ঢাকার উত্তরে অবস্থিত এক অভিজাত এলাকা, যেখানে নতুন বাড়ি, মসজিদ, মন্দির, সমাধি ও বাগান নির্মিত হয়। এ অঞ্চল একসময় মুঘলদের সামাজিক ও ধর্মীয় কার্যকলাপের কেন্দ্র ছিল।
তবে মুঘল শাসনের অবসান ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রমনার জৌলুস হারিয়ে যেতে থাকে। সময়ের পরিক্রমায় এটি পরিণত হয় পরিত্যক্ত ভবন, ঝোপঝাড়, কবরস্থান ও ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের অঞ্চলে। এই ঐতিহাসিক স্থানটির পুনর্জন্ম ঘটে ১৯৫২ সালে, যখন তৎকালীন সি অ্যান্ড বি বিভাগ (বর্তমানে গণপূর্ত অধিদপ্তর) এর আধুনিক রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
আধুনিক নকশা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
রমনা পার্ক বর্তমানে ঢাকার সবচেয়ে বড় এবং সুপরিকল্পিত উদ্যানগুলোর একটি। এর মোট আয়তন ৬৮.৫০ একর, যার মধ্যে ৮.৭৬ একরজুড়ে রয়েছে একটি নান্দনিক লেক। পার্কে বিভিন্ন ধরণের গাছপালা যেমন ফুল, ফলজ, ঔষধি ও বনজ বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে, যার সংখ্যা ১২২ প্রজাতিরও বেশি। এখানে নাগেশ্বরচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা, কর্পূর, রীঠা, নাগলিঙ্গম, অর্জুন, মহুয়া, কুসুম, তেলসু ও অশোক গাছ বিশেষভাবে চোখে পড়ে।
লেকের চারপাশে ও পার্কজুড়ে নির্মিত হয়েছে প্রশস্ত পথ, নতুন পাঁচটি গেট, ছাউনি, বসার স্থান এবং টয়লেট সুবিধা—যা নাগরিকদের জন্য এক নিঃশব্দ আরাম ও প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বর্তমানে রমনা পার্ক উদ্যানতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। এটি কেবল একটি বিনোদন কেন্দ্র নয়, বরং ঢাকা শহরের ইতিহাস ও নগর উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয় এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি সকল শ্রেণির মানুষের জন্য উন্মুক্ত ও উপভোগ্য করে তোলা যায়, তবে রমনা পার্ক হতে পারে ঢাকার এক অনন্য প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক আকর্ষণ।
রমনা পার্ক শুধু গাছপালা আর জলাধারের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্থান নয়, এটি ঢাকার অতীত ঐতিহ্য ও নাগরিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই পার্কে হাঁটলে যেন মুঘল আমলের ছায়া, বৃটিশ শাসনের স্মৃতি এবং আধুনিক শহর পরিকল্পনার নিদর্শন একসাথে মিশে যায়—যা প্রতিটি ঢাকাবাসীর গর্ব করার মতো।
উপসংহার
রমনা পার্ক শুধু একটি পার্ক নয়, এটি ঢাকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির এক অপূর্ব মিলনস্থল। প্রাচীন মুঘল ঐতিহ্য থেকে শুরু করে আধুনিক শহরায়নের নানা অধ্যায়ে এই পার্ক স্বাক্ষী হয়েছে সময়ের পরিবর্তনের। আজও এটি নাগরিক জীবনের এক শান্ত আশ্রয়স্থল, যেখানে প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া যায় কোলাহলময় নগরের মধ্যেও। তবে এর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়নের পাশাপাশি সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তখনই রমনা পার্ক হয়ে উঠবে একটি সর্বজনীন ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য—যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও প্রিয় থাকবে।
টিকিট এবং সময়সূচি
টিকিট :
বর্তমানে রমনা পার্ক সকল দর্শনার্থীদের বিনামূল্যে প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত, পার্কের ভিতরে প্রবেশ করতে কোন টিকিট সংগ্রহ বা ফি প্রদান করতে হয় না।
সময়সূচি:
নিচে টেবিল আকারে রমনা পার্কের সকাল ও বিকেলের সময়সূচি দেওয়া হলো:
সময়কাল | সময় |
---|---|
সকাল | সকাল ৬:০০ – দুপুর ১২:০০ |
বিকেল | বিকেল ২:০০ – রাত ৮:০০ |
অন্যান্ন তথ্য
বিশেষ দ্রষ্টব্য: রমনা পার্ক সম্পের্কে আরও বস্তারিত তথ্য জানতে উইকিপিডিয়ার বিস্তারিত আর্টিক্যাল দেখুন: দর্শনীয় স্থান: রমনা পার্ক
মানচিত্র
গুগলের মানচিত্রে রমনা পার্ক।