নবাবগন্জ একটি ইতিহাস ও ঐতিয্য সমৃদ্ধ উপজেলা, যেখেনে রয়েছে কলাকুপা প্রচীন জমিদার বা রাজবাড়ী, এছাড়াও এর অদূরেই রয়েছে কয়েকশো বছরের প্রাচীন খেলারাম দাতার কোঠা (Khelaram Datar Kotha) যা খেলারাম দাতার বিগ্রহ মন্দির হিসেবেও পরিচিত।
সূচিপত্র
খেলারাম দাতার রহস্যময় জীবন
খেলারাম দাতা ছিলেন ডাকাত দলের সরদার, ডাকাতি করেই করেছিলেন এই বিশাল মন্দির বা অন্ধকারকোঠা। কলাকুপার ইছামতি নদীর নৌপথে ডাকাতি করতেন তিনি এবং এই ডাকাতি করেই বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছিলেন তিনি, এবং গড়েছিলেন এরকম বিশাল মন্দির বা অন্ধকার কোঠা। তবে তিনি ডাকাত হলেও তার ডাকাতি করা সম্পদের বিরাট অংশ তিনি গরিবদের জন্য ব্যায় করেছিলেন, স্থানিয়দের মতে তার কাছে কেও কিছু চেয়ে খালি হাতে ফিরে যেত না বলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। আর সে কারনেই ডাকাত হয়েও তার নামের শেষে দাতা শব্দটি যুক্ত হয়ে তান নাম হয়ে যায় খেলারাম দাতা।
কথিত আছে ইছামতি নদী থেকে তার বাড়ী পর্যন্ত একটি সুরঙ্গ ছিল, ডাকাতি করে এ পথেই তিনি ধনসম্পদ নিয়ে আসতেন তার বাড়ীতে। খেলারাম দাতাকে দুই ধরনের ইতিহাস প্রচলিত রয়েছে, একটিতে বলা হচ্ছে তিনি ছিলেন ডাকাত দলের সর্দার অন্যটিতে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে ব্যবসায়ি হিসেবে।
বলা হয়েছে খেলারাম ছিলেন অনেক মাতৃ ভক্ত, মায়ের অনুমতি নিয়ে তিনি নোকা নিয়ে বানিজ্যে গিয়ে আবার ফিরে আসেন, এর পর তা গরীব দুখিদের মাঝে বিলিয়ে দেন। একবার খেলারামের মা তার কাছে আম দুধ খেতে চাইলে তিনি বাড়ি উপরে বিশাল চৌবাচ্চা তৈরিকরে তা আম দুধ দিয়ে ভর্তি করে সেখানে তার মাকে নিয়ে এসে নামিদেয় সেই চোবাচ্চায়, তার মা সাতার পেরে তা খেয়ে তৃপ্ত হন বলে কথিত রয়েছে।
কথিত আছে একদিন খেলারাম তার বাড়ির সামনের পুকুরে নেমে গোসল করতে পানিতে ডুব দেন এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও তিনি আর ওঠেননি এরপর, লোকজন নামিয়ে দিলে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। খেলারামদাতার মৃত্যুতে চারদিকে কান্নার রোল পড়ে যায়, কান্নার মধ্যে সবচেয়ে মর্ম বেধি ছিল তার মা য়ের কান্না।
নির্মাণকাল
খেলারাম দাতা ঠিক কবে অট্টালিকাটি তেরি করেছিলেন তার কোন সঠিক তথ্য কোথাও পাওয়া যায়না। কোন কোন ইতিহাস বিদ মনে করেন ১৯ শতকের শেষদিকে অথবা ২০ শতকের শুরুর দিকে এটি নির্মিত হয়ে থাকতে পারে। তবে স্থানিয়দের মতে এটি ৩ থেকে ৪ শত বছরের পুরনো।
নির্মানশৈলী
খেলারাম দাতার কোঠার স্থাপত্য নকশাটি খুবই মনোরম। বর্তমানে দ্বিতল ভবনটির উপরের অংশ পর্যন্ত টিকে রয়েছে। ভবণটির পিলার ও মিনার দেখে নির্মাণ কৌশলী সম্পর্কে সুস্পস্ট ধারণা পাওয়া যায়। মন্দিরটির নির্মাণ কৌশলীতে মুঘল রিতির প্রতিফলন রয়েছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপীয় ধারা। অতীতে মন্দিরটির রং ছিল লালচে, সাম্প্রতিক সময়ে সংস্কারের মাধ্যমে মন্দিরটির গায়ে সাদা রং এর প্রলেপ দেয়া হয়েছে।
দ্বিতল বিশিষ্ট ভবনের প্রতি তালায় ৮টি করে কক্ষ রয়েছে। প্রত্যেক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে অট্টালিকা টির চারপাশ দিয়ে প্রবেশ করা যায় এজন্য অট্টালিকার চারদিকে পাঁচটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। অট্টালিকাটির উত্তর-পশ্চিম কোণে দ্বিতীয় তলায় ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। দ্বিতীয় তলার ছাদে চার কোনায় চারটি গম্বুজ এবং গম্বুজ গুলোর মাঝখানে চারটি কুঁড়েঘর আকৃতির স্থাপনা দেশীয় সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটিয়েছে, এবং খেলাম দাদার কোঠার মাঝখানে উঁকি দিচ্ছে মন্দিরের মতো সুউচ্চ মঠ বা মিনার। মঠ আকৃতির এই ঘরটি মন্দির হিসেবে ব্যবহার করতেন খেলারাম।
ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে কোন এক রাতে এই ভবনটি মাটি ভেদ করে উপরে উঠে যায় হঠাৎ কেউ একজন দেখা দেখে ফেললে এটার উপরে ওঠা বন্ধ হয়ে যায় এবং কালের বিবর্তনে আস্তে আস্তে মাটির নিচে ডুবেজে থাকে। এটি যখন উঠেছিল তখন সাত থেকে আট তলা সমান উঁচু ছিল বলে স্থানীয়রা জানান, যা বর্তমানে দোতলা দৃশ্যমান রয়েছে।
আসলে খেলারামদাতা তার বাড়ির ভিতরেই তৈরি করেছিলেন মন্দিরটি যার কারণে অনেকের কাছে এটি পরিচিত খেলারামদাতার বাড়ি, কারও কাছে খেলারাম দাদার কোঠা আবার, কারও কারও কারও কাছে আন্ধারকোঠা হিসেবে। সংস্কারে আগে মন্দিরটি অনেক জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল যা বর্তমানে গ্রিল দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। ভবনটি অনেক জরাজীর্ণ এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল বলে একে অনেকে ভূতের বাড়ি বলেও ডেকে থাাকে। খেলারাম দাতার অট্টালিকাটি দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল, সরকার একে গুরুত্বপূর্ণ পুরাকৃতি হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষনা দিয়ে অট্টালিকাটি সংস্কার করেছে।
শেষকথা
খেলারামদাতার কোঠা বা আন্ধার কোঠা সত্যি সত্যি রহস্যে ঘেরা এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এখানে ঘুড়তে আসলে ভবনটির নির্মাণশৈলী এবং কাল্পনিক গল্পকথা আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে। শুধু খেলারামদাতার কোঠাই নয় এই কলাকোপা গ্রামে রয়েছে একাধিক পুরনো বাড়ি, মন্দির এবং স্থাপনা যা দেখতে দেখতে অনায়াসে আপনার একদিন চলে যাবে।
লোকমুখে শোনা যায় খেলারাম দাতা তার মায়ের আদেশে এলাকার অনেক সেবা ও জনকল্যামূলক কাজ করেছিলেন। এর মধ্যে অত্র এলাকায় বিশুদ্ধ পানির জন্য পুকুর বাঁ দিঘী খনন উল্লেখযোগ্য। খেলারাম দাতার কোঠার সম্মুখে রয়েছে একটি বিশাল দিঘী। খেলারাম দাদার এই অট্টালিকাটি দেখার জন্য অসংখ্য দর্শনার্থীরা ভিড় করেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অট্টালিকাটির ভিতরের অংশ দেখানোর ব্যবস্থা করলে দর্শনার্থীরা আরো আনন্দিত হতো।
গুগলের মানিচিত্রে খেলারাম দাতার কোঠা
কিভাবে যাবেন
প্রথমে আপনাকে ঢাকার গুলিস্থান থেকে এন মল্লিক পরিবহনে করে নামতে হবে নবাবগন্জের কলাকোপা বাসস্ট্যান্ডে। কলাকোপা বাসস্ট্যান্ডে নেমে সেখান থেকে রিকশাযোগে আন্ধারকোঠা নামক স্থানে যাবেন জানালে রিকশাওয়ালা আপনাকে নিয়ে যাবে আন্ধারকোঠায়। এবং এই আন্ধারকোঠা ই মূলত খেলারাম দাতার মন্দির।
তথ্যচিত্র
আন্ধারকোঠা বা খেলারাম দাতার মন্দির, নবাবগঞ্জ এর তথ্যচিত্র: