ঢাকা চিড়িয়াখানা (মিরপুর): বাংলাদেশের প্রাণিকুলের বৈচিত্র্যের এক অনন্য আয়োজন
ঢাকা চিড়িয়াখানা, যা মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানা নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুর এলাকায় অবস্থিত। এটি দেশের সর্ববৃহৎ চিড়িয়াখানা এবং প্রাণিকুলের প্রতি আগ্রহী মানুষদের জন্য একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। বাংলাদেশের প্রাণিবৈচিত্র্যকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে এই চিড়িয়াখানা ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রতিদিনের কর্ম ব্যস্ততা জীবন থেকে সবাই যখন একটু ভিন্নতা খুঁজতে চায় তখনই মানুষের ভিড় পড়ে এখানে, সবুজের ছোঁয়া আর প্রাণীকুলের সাথে সারাদিনের অদ্ভুত এক আনন্দের আবাসস্থল হল বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা। নির্মল এক আনন্দ এবং অজানার খোঁজে মুখরিত আমাদের জাতীয় এ চিড়িয়াখানা।
নাগরিক জীবনের যান্ত্রিক কর্মব্যস্ততাময় জীবন থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এখানে মানুষের চক্ষু স্থির হয়। এখানে ঢুকতেই চোখে পড়ে এক পাল হরিরণের, ওদের চোখে বৃষ্টি রেখে এক মায়ার খোঁজে ব্যস্ত থাকে দর্শনার্থীরা। একটু এগুলোই বানরের খাঁচা, সারাটা ক্ষণ বাদরামি আর দর্শনার্থীদের খাবার সংগ্রহী ব্যস্ত তারা। পাখিদের কলতান এড়িয়ে দূরে দেখা যায় জিরাফের উকি ঝুঁকি, নিবৃত্ত দুপুরে জেব্রার মগ্ন আহার, উৎসুক চোখে দেখা মিলবে ময়ূরের পেখম মেলার দৃশ্য।
এখানে একটু থামি কারণ প্রথমে চিড়িয়াখানার ইতিহাসটা একটু জেনে নেয়া যাক…
সূচিপত্র
চিড়িয়াখানার ইতিহাস
ঢাকা চিড়িয়াখানার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালের শেষের দিকে। ঢাকার সুপ্রিম কোর্টের সামনে বর্তমান ঈদ গাহ এলাকায় ৪ থেকে ৫ একর জায়গাজুড়ে এই চিড়িয়াখানা স্থাপন করা হয়েছিল। সেখানেই কিছু পাখি বানর আর হরিণ নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তিকালে ২৩ বছর পর ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন বর্তমান মিরপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘটে এই চিড়িয়াখানার। শুরুতেই এর নাম ছিল ‘বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা’। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
চিড়িয়াখানার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল দুর্লভ আর বিরল প্রজাতির প্রাণী সংগ্রহ ও নিরাপত্তা ও প্রজনন, গবেষণা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি শিক্ষামূলক এবং বিনোদনমূলক কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছে।
অবস্থান এবং আয়তন
মিরপুর ১ নম্বর এলাকায় অবস্থিত এই চিড়িয়াখানা প্রায় ১৮৬.৬৩ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। ভিতরে নজর কারা লেক রয়েছে প্রায় ৩৩ একর জায়গা নিয়ে। চারদিক ঘিরে শুধু সবুজ আর সবুজ আর আয়তনের দিক দিয়ে প্রায় বিশ্বের হাজারো চিড়িয়াখানাকে ছাড়িয়ে চতুর্থ এর অবস্থান।
চিড়িয়াখানার ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর জন্য আলাদা আলাদা এলাকা, বড় বড় জলাধার এবং সবুজ উদ্যান। এই বিস্তৃত আয়তন প্রাণীদের স্বাভাবিক পরিবেশের কাছাকাছি জীবনযাপনের সুযোগ প্রদান করে।
প্রাণিকুলের বৈচিত্র্য
প্রায় ২০০টি প্রজাতির, ২০৬৫০টি প্রাণীর অভয়ারণ্য এই চিড়িয়াখানা। দেখা মিলবে বহু প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় নাম না জানা প্রাণীরও। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
স্তন্যপায়ী প্রাণী
- গন্ডার: বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় গন্ডার এক গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ।
- জলহস্তি: এখানে দেখা মিলবে ছোট বড় একাধিক জল হস্তীর। সবুজ ঘাস, লতাপাতা, এবং তরমুজ ও বাঙ্গির মতো বিভিন্ন ফল খাওয়ায় এরা প্রায় সময়ই ব্যস্ত থাকে, আর খাবার শেষ হলে অবশ্য পাশের ছোট পুকুড়ের পানিতে বেশি সময় কাটায় অলসতায় সবচেয়ে এগিয়ে এই হস্তী গুলো।
- বাঘ: রয়েল বেঙ্গল টাইগার চিড়িয়াখানার প্রধান আকর্ষণ। এটি বাংলাদেশের জাতীয় পশু। চিড়িয়াখানা বলতেই বাঘ মামা দেখার আকর্ষণ, বাংলাদেশের চিড়িয়াখানা বলে কথা, চিড়িয়াখানায় রয়েলবেঙ্গল থাকবে না এটা ভাবা যায় না। লোহার খাঁচার ভিতর থাকলেও চোখের দৃষ্টি আর হুংকারে নিজের যাত্রা চেনাতে ভুল করে না এই প্রাণীটি।
- সিংহ: আফ্রিকান সিংহ চিড়িয়াখানার অন্যতম জনপ্রিয় প্রাণী। চিড়িয়াখানা নিয়ন্ত্রণ রয়েছে রাজা সাহেবের, যার এক হুকারই যথেষ্ট, আর খাওয়াটাও বাদশাহি ধাচের, সপ্তাহে খাবার হিসেবে রয়েছে ছয় দিন গরুর গোস্ত আর একদিন জ্যান্ত খরগোশ।
- হাতি: বিশালাকৃতির এ প্রাণীগুলি বিশেষ করে শিশুদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্র।
- বানর ও লেমুর: বিভিন্ন প্রজাতির বানর ও লেমুর দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন করে। সুযোগ পেলেই দর্শনার্থীদের ছুড়ে দেয়া রুটি ও চিনা বাদাম ইত্যাদি সংগ্রহ করে এরা।
- ভাল্লুক: ভাল্লুক আর একটি আকর্ষণীয় প্রাণী যা কিনা সময় পেলেই নাক ডুবিয়ে খায় আর খাওয়া শেষ হলে খাঁচা ঘিরে মানুষ যখন বেশি তখনই শুরু হয়ে যায় তার খেলাধুলা।
পাখি
দেশ ও বিদেশের কমপক্ষে ৫৬ প্রজাতির রংবেরঙের অসংখ্য পাখি পাখির দেখা মিলবে এখানে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- ময়ূর: তাদের রঙিন পালক দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
- ঈগল ও বাজ: বিভিন্ন প্রজাতির শিকারি পাখি এখানে দেখা যায়।
- তোতা ও টিয়া পাখি: এদের রঙ এবং ডাক দর্শনার্থীদের আনন্দ দেয়।
সরীসৃপ
- কুমির: বড় বড় জলাধারে রাখা কুমির দর্শকদের দৃষ্টি কাড়ে। আছে মিঠা পানির কুমির যারা লম্বায় চার থেকে পাঁচ মিটার ঘর খুঁজতে মাটির উপরেও যেতে পারে কয়েক কিলোমিটার সপ্তাহে দুই দিন সোয়া দুই কেজি গরুর মাংস তৈরি হয়ে যায় তার খাবার। এরাও সাধারণত পুরো শীতকাটায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।
- সাপ: চিড়িয়াখানায় রয়েছে নানা প্রজাতির বিষধর এবং নির্বিষ সাপ। এদের মধ্যে রয়েছে, অজগর, গোখরা, ইত্যাদি। চিড়িয়াখানায় গা শিউরে ওঠে সময় সময় খোলস পাল্টানো বিভিন্ন রংবেরঙের বিষধর সাপের ধীর চলাফেরা ও ফিসফিসানিতে। এদিকে অজগর শীতকালে এমন ঘুমায় যে কোন কিছুই খাওয়া লাগে না বাকি সময় সপ্তাহে একটি করে খরগোশ হলেই ব্যাস।
জলজ প্রাণী
চিড়িয়াখানার লেকে রয়েছে নানা প্রজাতির মাছ এবং কাছিম। এছাড়া বিভিন্ন জলচর পাখিও দেখা যায়।
চিড়িয়াখানার অন্যান্য আকর্ষণ
শিশু পার্ক
চিড়িয়াখানার ভেতরে শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা খেলার জায়গা। এখানে নানা রকম রাইড এবং বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।
শিক্ষামূলক কার্যক্রম
চিড়িয়াখানার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হল শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা। এখানে বিভিন্ন সময়ে প্রাণী সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে সচেতনতামূলক সেমিনার এবং প্রদর্শনী আয়োজিত হয়।
জলাধার এবং বোটিং
চিড়িয়াখানার ভেতরে বড় বড় লেক রয়েছে, যেখানে দর্শনার্থীরা নৌকাভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। লেকের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং আশেপাশের গাছপালা দর্শকদের মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা প্রদান করে।
দর্শনার্থীদের সুবিধা
চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা।
- খাবারের দোকান: চিড়িয়াখানার ভেতরে এবং বাইরে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকান।
- বিশ্রামের জায়গা: দর্শকদের বিশ্রামের জন্য বিভিন্ন জায়গায় বসার ব্যবস্থা রয়েছে।
- গাইড এবং তথ্যকেন্দ্র: নতুন দর্শনার্থীদের জন্য চিড়িয়াখানার তথ্যকেন্দ্র এবং গাইড রয়েছে, যারা দর্শনার্থীদের চিড়িয়াখানা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেন।
- জাদুঘর: নানান প্রাণী সম্পর্কে জানতে আরও রয়েছে জাদুঘর। বলা যায় দুলাভ নানাজাতের প্রাণীর বড়সড় সংগ্রহশালা, সঙ্গে সেগুলোর বিস্তর বর্ণনা।
পরিবেশ এবং নিরাপত্তা
চিড়িয়াখানার পরিবেশ বেশ পরিচ্ছন্ন এবং সবুজে ঘেরা। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ সবসময় সজাগ থাকে। এখানে প্রাণীদের জন্য বিশেষ যত্ন নেওয়া হয় এবং তাদের খাদ্য এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।
সমালোচনা এবং চ্যালেঞ্জ
যদিও ঢাকা চিড়িয়াখানা অনেকের কাছে একটি প্রিয় স্থান, তবে কিছু সমালোচনাও রয়েছে।
- প্রাণীদের আবাসস্থলের মান আরও উন্নত করা প্রয়োজন।
- দর্শনার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, যেন তারা প্রাণীদের বিরক্ত না করে।
- চিড়িয়াখানার আধুনিকায়নের জন্য আরও তহবিল এবং পরিকল্পনা প্রয়োজন।
উপসংহার
ঢাকা চিড়িয়াখানা বাংলাদেশের প্রাণিকুলের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরার একটি অনন্য স্থান। এটি শুধু বিনোদনের স্থান নয়, বরং শিক্ষামূলক এবং গবেষণামূলক কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। সঠিক পরিকল্পনা এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে এটি আরও আকর্ষণীয় এবং উন্নততর হতে পারে। ঢাকার ব্যস্ত জীবনের মাঝে এই চিড়িয়াখানা প্রকৃতি এবং প্রাণীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
টিকিট এবং সময়সূচি
সময়সূচি
মাস | সময় |
---|---|
এপ্রিল থেকে অক্টোবর | ৯ AM – ৬ PM |
নভেম্বর থেকে মার্চ | ৯ AM – ৫ PM |
বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা
দিন | সময় |
---|---|
রবিবার | বন্ধ |
সোমবার | ৯ AM – ৬ PM |
মঙ্গলবার | ৯ AM – ৬ PM |
বুধবার | ৯ AM – ৬ PM |
বৃহস্পতিবার | ৯ AM – ৬ PM |
শুক্রবার | ৯ AM – ৬ PM |
শনিবার | ৯ AM – ৬ PM |
চিড়িয়াখানা – কমন এল্যান্ড
দিন | সময় |
---|---|
রবিবার | বন্ধ |
সোমবার | ৯ AM – ৫ PM |
মঙ্গলবার | ৯ AM – ৫ PM |
বুধবার | ৯ AM – ৫ PM |
বৃহস্পতিবার | ৯ AM – ৫ PM |
শুক্রবার | ৯ AM – ৫ PM |
শনিবার | ৯ AM – ৫ PM |
চিড়িয়াখানা – জলহস্তী
দিন | সময় |
---|---|
রবিবার | বন্ধ |
সোমবার | ৯ AM – ৫ PM |
মঙ্গলবার | ৯ AM – ৫ PM |
বুধবার | ৯ AM – ৫ PM |
বৃহস্পতিবার | ৯ AM – ৫ PM |
শুক্রবার | ৯ AM – ৫ PM |
শনিবার | ৯ AM – ৫ PM |
হরিণ অঞ্চল
দিন | সময় |
---|---|
রবিবার | বন্ধ |
সোমবার | ৯ AM – ৬ PM |
মঙ্গলবার | ৯ AM – ৬ PM |
বুধবার | ৯ AM – ৬ PM |
বৃহস্পতিবার | ৯ AM – ৬ PM |
শুক্রবার | ৯ AM – ৬ PM |
শনিবার | ৯ AM – ৬ PM |
টিকিট
চিড়িয়াখানার টিকেট ফি ও গাড়ি পার্কিংয়ের হার নিচে টেবিল আকারে দেওয়া হলো:
প্রবেশ ফি
সেবা | মূল্য (BDT) |
---|---|
প্রধান গেট এন্ট্রান্স ফি (২ বছরের বেশি) | ৫০/- |
চিড়িয়াখানা মিউজিয়াম এন্ট্রান্স ফি | ১০/- |
শিশু (২ বছরের নিচে) | ফ্রি |
ছাত্র (শুধুমাত্র আইডি কার্ড সহ) | অর্ধেক |
গাড়ি পার্কিংয়ের হার
নং | বাহনের বর্ণনা | ফি/মূল্য (BDT) |
---|---|---|
১ | ভারী বাহন যেমন বাস, ট্রাক, লরি, মিনিবাস, কার্গো, ডাবল-ডেকার, ইত্যাদি | ৪০/- |
২ | ছোট মোটর বাহন যেমন মাইক্রোবাস, ট্যাক্সি, জিপ, কার, পিকআপ, ইত্যাদি | ২০/- |
৩ | সিএনজি স্কুটার, অটো টেম্পো, মোটরসাইকেল, মিশুক, ইত্যাদি | ১০/- |
৪ | রিকশা, রিকশা ভ্যান, সাইকেল, ইত্যাদি | ২/- |
অন্যান্ন তথ্য
বিশেষ দ্রষ্টব্য: টিকেটের বর্তমান মূল জানতে, ও অন্যান্য আরো তথ্য জানতে সরাসরি বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার ওয়েব সাইট ভিজিট করুন: https://bnzoo.org/
মানচিত্র
গুগলের মানচিত্রে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা, মিরপুর, ঢাকা।