ঢাকার কোলাহলপূর্ণ নগরজীবনের মাঝে অবস্থিত বলধা গার্ডেন এক নিরিবিলি প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল। রাজধানীর পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকায় অবস্থিত এই বাগানটি কেবল একটি উদ্যান নয়—এটি ইতিহাস, প্রকৃতি এবং সৌন্দর্যের এক অপূর্ব সম্মিলন। ১৯০৯ সালে ব্রিটিশ ভারতের খ্যাতনামা জমিদার ও উদ্ভিদপ্রেমী নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে তোলেন এই বাগানটি, যা আজও তার স্বপ্ন ও ভালোবাসার পরিচয় বহন করে।
সূচিপত্র
ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প
নরেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন বলধা এস্টেটের জমিদার। তিনি ইংরেজি, সংস্কৃত ও উদ্ভিদবিজ্ঞানে দক্ষ ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল এমন একটি উদ্ভিদ উদ্যান গড়ে তোলা, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা বিরল ও বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদের একত্রিত রূপ থাকবে। প্রায় ৩০ বছর সময় ধরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি এই কাজ চালিয়ে যান। গার্ডেনটির নামকরণ করেন গ্রিক পুরাণ থেকে নেওয়া দুই দেবীর নামে: Psyche (সাইক) ও Cybele (সিবেলি)।
উদ্ভিদের বৈচিত্র্য ও বিশেষ আকর্ষণ
বলধা গার্ডেনে প্রায় ১৫,০০০টির বেশি গাছপালা রয়েছে যা প্রায় ৬৭২টি প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ, এবং সেগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৮৭টি উদ্ভিদ পরিবারে। এখানে এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে সংগ্রহ করা উদ্ভিদ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- বাওবাব (Adansonia digitata) – আফ্রিকা থেকে আনা বিরল গাছ
- অর্কিড, ক্যাকটাস, লিলি, মেহগনি
- ক্যামেলিয়া – এই ফুল দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন কবিতা ‘ক্যামেলিয়া’
- প্যাপিরাস (Cyperus papyrus) – প্রাচীন মিশরীয় কাগজ তৈরিতে ব্যবহৃত উদ্ভিদ
- অমজন পদ্ম (Victoria regia) – বিশালাকৃতির জলজ ফুল
এছাড়া আলাদা ঘরে সংরক্ষিত রয়েছে এলোভেরা, আইভি (Ficus ripens var. heterophylla), বিভিন্ন প্রজাতির ফার্ন এবং ঔষধি গাছ।
উদ্যানের গঠন: সাইক ও সিবেলি
গার্ডেনটি প্রায় ৩.১৫ একর আয়তনের এবং এটি দুইটি ভাগে বিভক্ত:
১. সাইক (Psyche)
এই অংশে রয়েছে মনোরম ফুলের বাগান, শাপলার পুকুর, নানা রঙের জলজ উদ্ভিদ ও জলাধার। বিশেষভাবে সাজানো শোভাময় উদ্ভিদ ছাড়াও এখানে রয়েছে ক্যাকটাস ও প্যাপিরাসের মতো নির্দিষ্ট অঞ্চলের উদ্ভিদ।
২. সিবেলি (Cybele)
সিবেলি অংশে রয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন ও বড় আকৃতির গাছের সংগ্রহ, একটি ঐতিহাসিক পুকুর – শঙ্খনিধি পুকুর, এবং একটি সূর্যঘড়ি (Sundial), যা সময় পরিমাপে ব্যবহৃত হতো। এটি গার্ডেনটির অপেক্ষাকৃত ছায়াযুক্ত, নিঃশব্দ এবং রহস্যময় অঞ্চল।
সংরক্ষণ ও বর্তমান অবস্থা
নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর ১৯৪৩ সালে গার্ডেনটির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাহত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে এটি বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগের অধীনে আসে এবং জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে পরবর্তীতে সিবেলি অংশের একটি অংশ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে যাওয়ায় পরিবেশগত ক্ষতি এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যা দেখা দেয়।
বর্তমানে এটি সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত, এবং এটি ঢাকায় শিক্ষা, গবেষণা ও ফটোগ্রাফির জন্য একটি আকর্ষণীয় কেন্দ্র। তবে, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা না থাকায় মাঝে মাঝে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগও পাওয়া যায়।
উপসংহার
বলধা গার্ডেন কেবল একটি প্রাকৃতিক উদ্যান নয়—এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও সৌন্দর্যের এক জীবনন্ত দলিল। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রকৃতির সংরক্ষণ, ঐতিহ্যের গুরুত্ব এবং এক ব্যক্তির একাগ্রতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক—এটাই প্রত্যাশা।
সময়সূচি ও টিকেট
সময়সূচি
দিন | সময় |
---|---|
সোমবার | সকাল ৮:৩০ – সন্ধ্যা ৭:০০ |
মঙ্গলবার | সকাল ৮:৩০ – সন্ধ্যা ৭:০০ |
বুধবার | সকাল ৮:৩০ – সন্ধ্যা ৭:০০ |
বৃহস্পতিবার | সকাল ৮:৩০ – সন্ধ্যা ৭:০০ |
শুক্রবার | সকাল ৮:৩০ – সন্ধ্যা ৭:০০ |
শনিবার | সকাল ৮:৩০ – সন্ধ্যা ৭:০০ |
রবিবার | সকাল ৮:৩০ – সন্ধ্যা ৭:০০ |
টিকেট
বলধা গার্ডেনে প্রবেশ টিকেট সংক্রান্ত তথ্য ও টিকেট মূল্য নিচে টেবিল আকারে দেওয়া হলো:
শ্রেণী | প্রবেশমূল্য | মন্তব্য |
---|---|---|
সাধারণ প্রবেশ (প্রাপ্তবয়স্ক) | ১০০ টাকা | – |
১২ বছরের কম বয়সী | ৫০ টাকা | – |
বিদেশী পর্যটক | ১০০০ টাকা | – |
শিক্ষার্থীদের দল (১০০ জন পর্যন্ত) | ১,০০০ টাকা | শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রবেশ |
শিক্ষার্থীদের দল (১০০ জনের বেশি) | ১,৫০০ টাকা | শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রবেশ |
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে শরীরচর্চা | বার্ষিক ৫০০ টাকা | শরীরচর্চার জন্য প্রবেশ কার্ড |
মানচিত্র
গুগলের মানচিত্রে বলধা গার্ডেন।