সুপ্রিয় পাঠক, আজ আপনাদের পরিচয় করে দেবো বাংলাদেশের একটি অদেখা স্থান “বোবারথল” কে!
সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করলে রিলসের মধ্যে কোনো দর্শনীয় স্থান কিংবা নির্মল সবুজ ট্রাভেল ডেস্টিনেশনের স্বল্পদৃশ্যের আকর্ষণীয় রিলস পাওয়া যাবে না এমনটা নেই। প্রতিনিয়ত ওয়েভমেকার জেন-জি এর সোশ্যাল রিলসে নেটিজেনদের মুগ্ধতার দৃষ্টি কাড়ে বদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তবে এই ট্রেন্ডে উঠে আসেনি । বাংলাদেশ – ভারত সীমান্তের আসাম ও ত্রিপুরা ঘেষা এক জনপদ “বোবারথল”। প্রাকৃতিক সব রূপলাবন্য ও ঐতিহাসিক জীবনধারা নিয়ে এখনো লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এই ”বোবারথল”। দুর্গম যোগাযোগ আর বাংলাদেশের সর্বপূর্বের সীমান্তবর্তী ডেস্টিনেশনটিতে প্রচারের অভাবে এখনো পা পড়েনি ভ্রমণবাজদের।
সুউচ্চ পাহাড়ি ট্রেইল, অগণিত প্রাকৃতিক ঝর্ণা, বিশাল লেক, গিরিখাত, বৈচিত্র্যময় আদিবাসী সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক স্থানীয় জীবনধারা নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ভ্রমণ গন্তব্য বোবারথল। এডভ্যাঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের জন্য এটি একটি আদর্শ গন্তব্য। ঢাকা থেকে প্রায় ২৩০ কি.মি. দূরে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নে এর অবস্থান। বোবারথলে যাত্রাটা কিছুটা সরল ও কিছুটা রোমাঞ্চকর তবে পুরো জার্নিটা দারুণ উপভোগ্য।
বোবারথল যাত্রায় আমাদের চমক শুরু হয় পাহাড় ও চা-বাগানের বুক চিরে ছুটে চলে ট্রেন জার্নি দিয়ে। ঢাকা থেকে এসে নামতে হয় কুলাউড়া জংশনে। তারপর লোকাল বাস কিংবা অটোতে পৌঁছাতে হয় বড়লেখা উপজেলা সদরে। তারপর মাত্র ১০ মিনিটে অটোযোগে পৌঁছাতে হবে বোবারথলের প্রবেশদ্বার ছোটলেখা বাজারে। তারপর শুরু হবে চাদের গাড়ি কিংবা জীপ গাড়িতে পাহাড়-টিলা আর চা বাগানের বুক চিরে এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। ক্রমাগত পাহাড়ার চূড়া আর ঢালুপথ পাড়ি দিতে হবে আপনাকে, যত সামনে আগাবেন আপনি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শত মিটারে উপরে উঠবেন আর হারিয়ে যাবেন সবুজের আবৃত এক পাহাড়ি জনপদের গহীনে।
শীত কিংবা বর্ষার যেই সিজনে আপনি যাত্রা করেন না কেনো দিনের যেকোনো সময়ে সেখানে পৌঁছালে পথিমধ্যে আপনি উপভোগ করবেন সাজেক ও বান্দরবনের আদলের সৃষ্টিকর্তার অপরুপ সৃষ্টি। প্রাকৃতিক এই লীলাভূমিতে প্রবেশ করার দু’টি রাস্তা রয়েছে, আপনি যদি গগণটিলা (হরতকি টিলা) দিয়ে প্রবেশ করেন তবে এই এলাকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ (পাথারিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অংশ) গগণটিলার বিশালতা উপভোগ করবেন। গগণটিলা থেকেই পতিত দুটি প্রাকৃতিক ঝর্ণায় আপনি গা ভিজিয়ে নিতে পারবেন। তার পাশেই রয়েছে খাসিয়া সম্প্রদায়ের ছবির মতো সাজানো গ্রাম গান্ধাই পুঞ্জি। সেখানে উঁকি মেরে দেখে আসতে পারেন সমৃদ্ধ আদিবাসী জীবনযাপন, বিশেষভাবে পান ও সুপারির ঝুমচাষ কিভাবে তাদের অর্থনীতিকে মজবুত করেছে।
আপনি যদি ছোটলেখা চা বাগানের ভেতর দিয়ে বোবারথল নয়া বাজার রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করেন তবে জীপ গাড়িতে যাত্রাপথের অর্ধেকটা সময় পার করবেন ছবির মতো সুন্দর চা বাগানের মধ্যে। উঁচু পাহাড় চড়তে শুরু করার আগেই আপনার যাত্রায় যোগ হবে ছোটলেখা লেক এর জলরাশির আচ্ছাদন। প্রায় দেড় কি.মি. বিস্তৃত এই পাহাড়ি লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আপনি চারপাশের সুউচ্চ পাহাড়ে আবৃত হীম শীতল আবহে গা ছিমছিম ভয়ংকর অনুভূতি পাবেন। তার পাশেই রয়েছে আরেকটি আদিবাসী পল্লী ‘আগার পুঞ্জি’। খাসিয়া ও গারোদের এই পুঞ্জিতে আপনি ঢুঁ মেরে দেখে আসতে পারেন তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা। নয়তো সোজা পথে উঁচু উঁচু পাহাড় পাড়ি দেয়ার রক্ত হীম করা এক জীপ জার্নি শেষ করে এসে পৌঁছারে পারেন বোবারথলের মূল জনপদে।
বোবারথলে পৌঁছে আপনি ছোট ছোট ৮ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি রহস্যঘেরা পাহাড়ি বাঙালি জনপদে অনেকটা সেকেলে সভ্যতার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন। স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্গানিক কৃষিপন্য, ঐতিহ্যগত খাবার, বিভিন্ন অচেনা ফল আর গ্রামীন আতিথিয়েতার এক আবহমান বাংলার খাঁটি জীবনধারা। প্রতিটি পাহাড় ও টিলার বাঁকে ছোট ছোট বাড়ি এবং গৃহস্থালি আয়োজন। প্রায় প্রতিটি বাড়ি ঘিরে পান ও সুপারি চাষ। জাম্বুরা, লেবু, জামির বা জাড়া (বিশেষ জাতের বড় লেবু), কমলা, লটকনসহ বিভিন্ন পাহাড়ি ফলের গাছগাছালির দেখা পাবেন প্রতিটি বাড়িতে। কৃষিতে সমৃদ্ধ এই জনপদের মানুষ স্থানীয় উৎপাদনে তাদের বেশিরভাগ চাহিদার যোগান নিশ্চিত হয়।
বোবারথলে আপনি ঘুরে দেখতে পারবেন পেকুছড়া ঝর্ণা, করইছড়া ঝর্ণা, পরিরঢর ঝর্ণা (মুরাগঞ্জ ছড়া), গগণটিলা ঝর্ণা, ষাটঘরি সীমান্ত ছড়াসহ ছোট বড় ৮টি ঝর্ণা। এখানকার প্রতিটি পাহাড়ি ঝিরির উপরিভাগে গহীন পাহাড়ে একটি করে ঝর্ণা রয়েছে, যেগুলোর কোনো নাম ও স্বীকৃতি নেই। স্থানীয়দের কাছে এসব ঝর্ণা বিশুদ্ধ পানির উৎস ছাড়া বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। এছাড়া গান্ধাই কয়লাটিলা, হরতকি চুনাপাহাড়, সাততলা টিলা (প্রাকৃতিক ব্রিজ), ছোটলেখা লেক, গগণটিলা, ছোটলেখা চা বাগান, জিংগাআলা শাহবাজপুর চা বাগান, গান্ধাই পুঞ্জি, আগারপুঞ্জি, ডিমাই পুঞ্জি ও বাংলাদেশের একমাত্র মুসলিম খাসিয়া পল্লি ‘মাঝ গান্ধাই পুঞ্জি’।
বোবারথলকে অন্বেষণ করতে আপনাকে দুই দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে হবে। বোবারথল ভ্রমণের সাথে আপনি দেখে আসতে পারেন সিলেটের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড ও এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকি হাওর। বড়লেখা উপজেলা সদর থেকে ১৫ কি.মি. দূরতে আপনি পৌঁছাতে পারেন মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ও হাকালুকি হাওরে একই সাথে ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহাসিক খোঁজার মসজিদ ও পাথারিয়া পাহাড়।
পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় বোবারথলে এখনো সরকারিভাবে কোনো পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তবে এই পাহাড়ি জনপদের মাঝে সরকারি সহযোগিতায় প্রথমবারের মতো সেখানে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম চালু করেছে অভিগো নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। স্থানীয়দের বাড়িতে স্বল্প খরচে হোম-স্টে ও ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় খাবারসহ গাইডেড ট্যুর করার সুবিধা রয়েছে সেখানে। এজন্য আপনাকে আগাম অভিগো’র মাধ্যমে হোম-স্টে বুক করতে হয়। তারা আপনার যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ব্যবস্থা করে দিবে।
বোবারথল জুড়ে অনেক পৌরানিক ভুতের গল্প এখনো প্রচলিত সেখানে গেলে স্থানীয়দের মুখে তা শুনতে মিস করবেন না কিন্তু। আর সবার কাছে একটাই অনুরোধ, এই জায়গা গুলো কিন্তু আর ১০টা পর্যটন স্থানের মত না, সেখানে গিয়ে এমন কিছু করবেন না যাতে স্থানীয়দের কোন সমস্যায় পড়তে হয়।
কালেক্টেড পোষ্ট:
লেখেছেন: Foiag Ahamed Pranto
লেখের উৎস: https://www.facebook.com/share/p/D8kUV1DrJuM1VFGs/